বর্তমানে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের অধীনে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্র, তিন বছর মেয়াদি তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র এবং পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্র চালু আছে। এছাড়া বাংলাদেশ প্রাইজবন্ড, ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউ. এস. ডলার প্রিমিয়াম বন্ড ও ইউ. এস. ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড নামে সঞ্চয় বন্ড চালু আছে। অন্যান্য স্কিমের মধ্যে রয়েছে ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক-সাধারণ হিসাব, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক- মেয়াদী হিসাব এবং (ক) ডাক জীবন বীমা (আজীবন) ও (খ) ডাক জীবন বীমা (মেয়াদি)।
সঞ্চয়পত্র প্রচলনের
পেছনে উদ্দেশ্য ছিলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী,
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও বিশেষ শ্রেণীর জনগণকে আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা প্রদান, মুদ্রাস্ফীতি
নিয়ন্ত্রণ, অর্থ পাচার রোধ, ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট রোধ, সরকারি ঋণের সুষম ব্যবস্থাপনা
প্রভৃতি। এসব উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকার সময়ে সময়ে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার পর্যালোচনা
করে থাকে। কাজেই সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার বাড়ানো বা কমানো নতুন কোন বিষয় নয়। বাজারের
মুনাফার/সুদের হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য না হলেই সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার পর্যালোচনা করা
হয়। প্রয়োজনে সরকার প্রতি বছর বা কয়েকবছর পরপর মুনাফার হার পর্যালোচনা করতে পারে। তারই
ধারাবাহিকতায় সরকার গত 21 সেপ্টেম্বর 2021 খ্রিঃ তারিখে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার পুণঃনির্ধারণ
করেছে। এর আগে সরকার ২০১৫ সালের ২৩ মে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমিয়েছিল।
সঞ্চয়পত্রের মুনাফার
হার কেন কমানো হয়েছে সে প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে জেনে নেওয়া যাক মুনাফার হার কতটা
কমানো হয়েছে এবং এর ফলে আদৌ উদ্বিগ্ন হওয়ার মত কিছু আছে কিনা।
ছক-১
ক্রম নং |
সঞ্চয়স্কিমের নাম |
মেয়াদ |
মেয়াদান্তে বিদ্যমান মুনাফার হার |
ক্রমিক 1-9 এ বর্ণিত সকল সঞ্চয় স্কিমে
ক্রমপুঞ্জিভুত বিনিয়োগের পরিমাণ |
||
15,00,000 টাকা পর্যন্ত |
15,00,001 টাকা হতে 30,00,000 টাকা
পর্যন্ত |
30,00,001 টাকা হতে তদুর্ধ্ব |
||||
পুণঃনির্ধারিত মুনাফার হার |
||||||
০১ |
৫-বছর মেয়াদী বাংলাদেশ
সঞ্চয়পত্র |
৫ বছর |
১১.২৮% |
১১.২৮% |
10.30% |
9.30% |
০২ |
৩-মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক
সঞ্চয়পত্র |
৩ বছর |
১১.০৪% |
১১.০৪% |
10% |
9% |
০৩ |
পেনশনার সঞ্চয়পত্র |
৫ বছর |
11.76% |
11.76% |
10.75% |
9.75% |
04 |
পরিবার সঞ্চয়পত্র |
৫ বছর |
১১.৫২% |
১১.৫২% |
10.50% |
9.50% |
০৫ |
ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক-সাধারণ
হিসাব |
- |
৭.৫০% |
৭.৫০% |
৭.৫০% |
৭.৫০% |
০৬ |
ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক-
মেয়াদি হিসাব |
৩ বছর |
১১.২৮% |
১১.২৮% |
10.30% |
9.30% |
ছক-২
ক্রম নং |
সঞ্চয়স্কিমের নাম |
মেয়াদ |
মেয়াদান্তে বিদ্যমান মুনাফার হার |
ক্রমিক 1-9 এ বর্ণিত সকল সঞ্চয় স্কিমে
ক্রমপুঞ্জিভুত বিনিয়োগের পরিমাণ |
|||
15,00,000 টাকা পর্যন্ত |
15,00,001 টাকা হতে 30,00,000 টাকা
পর্যন্ত |
30,00,001 টাকা হতে 50,00,000 টাকা
পর্যন্ত |
50,00,001 টাকা হতে তদুর্ধ্ব |
||||
পুণঃনির্ধারিত মুনাফার হার |
|||||||
07 |
ওয়েজ
আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড |
৫ বছর |
১2% |
১2% |
11% |
10% |
9% |
08 |
ইউএস ডলার প্রিমিয়াম
বন্ড |
3 বছর |
7.5% |
7.5% |
7.5% |
7.5% |
7.5% |
09 |
ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট
বন্ড |
3 বছর |
6.5% |
6.5% |
6.5% |
6.5% |
6.5% |
পুণঃনির্ধারিত মুনাফার ছক বিশ্লেষণ করলে আমরা
দেখতে পাই:
·
জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের মুনাফার হার পুন:নির্ধারণের ক্ষেত্রে জাতীয়
সঞ্চয় অধিদপ্তর প্রবর্তিত ১১টি সঞ্চয় স্কিমের মধ্যে ৯টি স্কিমকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে,
অর্থাৎ ৩টি স্কিম যথা: বাংলাদেশ প্রাইজবন্ড (মুনাফার হার: 6.5%), (ক) ডাক জীবন বীমা
(আজীবন) [প্রিমিয়াম: 4.2%] ও (খ) ডাক জীবন বীমা (মেয়াদি) [প্রিমিয়াম: 3.3%] কে এর আওতার
বাইরে রাখা হয়েছে।
·
মুনাফার হার পুন:নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে ৯টি স্কিমকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে তন্মধ্যে ৩টি
স্কিম যথা: ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক-সাধারণ হিসাব, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড ও ইউএস ডলার
ইনভেস্টমেন্ট বন্ড এর মুনাফার হারের কোন পরিবর্তন করা হয়নি।
·
সঞ্চয় স্কিমসমূহের বিনিয়োগের উর্ধ্বসীমার কোন পরিবর্তন করা
হয়নি অর্থাৎ ৫-বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, ৩-মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র
ও পরিবার সঞ্চয়পত্রে একক নামে সর্বোচ্চ 50 লক্ষ অথবা যৌথনামে সর্বোচ্চ 1 কোটি টাকা
বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া পেনশনার সঞ্চয়পত্রে একক নামে সর্বোচ্চ 50 লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করা যাবে।
·
ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক-সাধারণ হিসাব এ একক নামে সর্বোচ্চ 10 লক্ষ
অথবা যৌথনামে 20 লক্ষ টাকা এবং ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক- মেয়াদি হিসাব এ একক নামে সর্বোচ্চ
10 লক্ষ অথবা যৌথনামে সর্বোচ্চ 20 লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করা যাবে।
·
অনিবাসী বাংলাদেশীগণ ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার
প্রিমিয়াম বন্ড ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড এর যে কোনটিতে অথবা সবগুলোতে সমন্বিতভাবে
সর্বোচ্চ 1 কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে পারবেন।
·
সঞ্চয় স্কিমসমূহে ইতোপূর্বে বিনিয়োগের মুনাফার হারের কোন পরিবর্তন করা হয়নি।
·
15 লক্ষ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফার হারের কোন
পরিবর্তন করা হয়নি।
·
ক্রমপুঞ্জিভুত বিনিয়োগ 5 লক্ষ বা তার কম হলে উৎসে কর কর্তন
পূর্বের ন্যায় 5% রাখা হয়েছে।
·
পেনশনার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ 5 লক্ষ বা তার কম হলে তা পূর্বের
ন্যায় আয়করমুক্ত রাখা হয়েছে।
·
6টি সঞ্চয় স্কিম যথা: ৫-বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, ৩-মাস
অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, পেনশনার সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র, ডাকঘর সঞ্চয়
ব্যাংক-সাধারণ হিসাব ও ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক- মেয়াদি হিসাব এ বিনিয়োগের জন্য 3টি স্ল্যাব নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
প্রথম স্ল্যাবের জন্য অর্থাৎ 15 লক্ষ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের মুনাফার হারের কোন পরিবর্তন
করা হয়নি। দ্বিতীয় স্ল্যাবের জন্য অর্থাৎ পরবর্তী 15 লক্ষ টাকার জন্য মুনাফার হার মাত্র
1% কমেছে; অনুরূপভাবে তৃতীয় স্ল্যাবের জন্য অর্থাৎ 30 লক্ষ টাকার বেশি বিনিয়োগের জন্য
2% এর মত মুনাফা হ্রাস পেয়েছে।
·
3টি সঞ্চয় বন্ড যথা: ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার
প্রিমিয়াম বন্ড ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড এর জন্য 4টি স্ল্যাব নির্ধারণ করে দেওয়া
হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড এর ক্ষেত্রে স্ল্যাব ভিত্তিক মুনাফা
কার্যকর হবে, অপরাপর দুটি বন্ডের মুনাফার হার স্ল্যাব ভিত্তিক করা হলেও অপরিবর্তিত
হয়েছে।
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের স্ল্যাব অনুধাবন:
ধরা যাক, জনাব নাসরিন
জাহান নামের এক ভদ্র মহিলা প্রথমে 45 লক্ষ টাকা পরিবার সঞ্চয়পত্রে এবং পরে 5 লক্ষ টাকা তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক
সঞ্চয়পত্রে নতুন বিনিয়োগ করতে চান। তাঁর পূর্বে
কোন সঞ্চয় স্কিমে কোন প্রকার বিনিয়োগ ছিল না। সেক্ষেত্রে মেয়াদান্তে তার প্রাপ্য নীট
মুনাফা কেমন/কত হবে? চলুন দেখা যাক:
·
প্রথম 15 লক্ষ টাকার জন্য প্রাপ্য মুনাফা হবে= 11.52% হারে
অর্থাৎ মাসিক 15×864= 12,960/-
·
দ্বিতীয় 15 লক্ষ টাকার জন্য প্রাপ্য মুনাফা হবে= 10.50% হারে
অর্থাৎ মাসিক 787.5×15= 11,812.50
·
তৃতীয় 15 লক্ষ টাকার জন্য প্রাপ্য মুনাফা হবে= 9.50% হারে অর্থাৎ
মাসিক 15×712.50= 10,687.50
সুতরাং জনাব নাসরিন জাহান 45 লক্ষ টাকা পরিবার সঞ্চয়পত্রে
বিনিয়োগ করে মাসিক মুনাফা পাবেন: (12,960+11,812.50+10,687.50)=35,460/-
একই পরিমাণ টাকা
পরিবার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে তিনি পূর্বে মাসিক মুনাফা পেতেন= 38,880 টাকা। অর্থাৎ
বর্তমানে মুনাফা কম পাবেন: 38,880-35,460= 3,420/- মাত্র।
·
5 লক্ষ টাকা তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের
উপর জনাব নাসরিন জাহান ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে মুনাফা পাবেন 9% হারে অর্থাৎ তিন মাস অন্তর
মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের তৃতীয় স্ল্যাবের হারে, কেননা তাঁর ক্রমপুঞ্জিভুত
বিনিয়োগ ইতোমধ্যে 30 লক্ষ টাকা অতিক্রম করেছে। সুতরাং তিনি 5 লক্ষ টাকার জন্য ত্রৈমাসিক
ভিত্তিতে মুনাফা পাবেন: 2025×5=10,125/- যা পূর্বে ছিল 12,420/- অর্থাৎ তিনি ত্রৈমাসিক
ভিত্তিতে 2,295 টাকা পূর্বের তুলনায় কম পাবেন।
সুতরাং সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার পুন:নির্ধারণের
মাধ্যমে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের মূল উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হয়েছে, কেননা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী,
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও বিশেষ শ্রেণীর মানুষ তথা নারী, বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক, পেনশনার ও
শারীরিক প্রতিবন্দ্বী ব্যক্তিরা মুনাফার হার পুন:নির্ধারণের ফলে মোটেও ক্ষতিগ্রস্ত
হবেন না। ফলত সাধারণ নাগরিকদের মুনাফার হার পুনঃনির্ধারণের ফলে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু
নেই।
সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার পুণ:নির্ধারণ কেন
জরুরি ছিল এবার সে প্রসঙ্গে আসা যাক। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এখনও উন্নয়ন
কর্মকান্ডের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। এজন্য সরকার প্রতি বছর উন্নয়ন বাজেট করে থাকে।
উন্নয়ন বাজেটের আরেক নাম ঘাটতি বাজেট। চলতি ২০১১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১
কোটি টাকার বাজেট জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছে। সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ১৪ হাজার
৬৮১ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে, যা জিডিপির ৬.২ শতাংশ। এ ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক সূত্র
থেকে ১ লাখ ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা
আহরণ করা হবে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা
এবং সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক বহির্ভূত উৎস থেকে ৩৭ হাজার ১ কোটি টাকা।